যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী

শ্যামাচরণ লাহিড়ী ( ইংরেজি :
Shyama Charan Lahiri
বাংলা: [Shêmā Chôron Lahiṛi] ) (৩০ সেপ্টেম্বর ১৮২৮ [১] – ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৯৫), যিনি লাহিড়ী মহাশয় নামে বেশি পরিচিত, একজন ভারতীয় যোগী এবং
মহাবতার বাবাজির শিষ্য ছিলেন। মহাবতার বাবাজির কাছে শিখে, ১৮৬১ সালে তিনি ক্রিয়াযোগ যোগবিজ্ঞানকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। লাহিড়ী মহাশয়
যুক্তেশ্বর গিরিরও গুরু ছিলেন। 'মহাশয়', সংস্কৃততে একটি আধ্যাত্মিক উপাধি যার অর্থ হল 'উদার মনের অধিকারী'। [২] তিনি ভারতীয় ধর্মগুরুদের থেকে অন্যরকম ছিলেন। তিনি সাধারণ
গৃহস্থের মত বিয়ে করেন, পরিবার পালন করেন এবং ব্রিটিশ ভারত সরকারের সামরিক প্রকৌশল বিভাগের একজন হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করেন। শ্যামাচরণ মন্দির বা মঠের পরিবর্তে বারাণসীতে তাঁর পরিবারের সাথে বসবাস করেন। তিনি ১৯ শতকের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য খ্যাতি অর্জন করেন।
শ্যামাচরণ, যুক্তেশ্বর গিরির শিষ্য পরমহংস যোগানন্দ এবং তাঁর লিখিত অটোবায়োগ্রাফি অফ এ যোগীর মাধ্যমে পাশ্চাত্যে পরিচিত হয়ে ওঠেন। যোগানন্দ লিখেছেন যে শ্যামাচরণকে লুপ্তপ্রায় ক্রিয়াযোগ অনুশীলন, বিশ্বে পুনর্ব্যক্ত করার জন্য মহাবতার বাবাজি দ্বারা নির্বাচিত করা হয়েছিল। শ্যামাচরণের শিষ্যদের মধ্যে যোগানন্দের বাবা-মায়ের পাশাপাশি যোগানন্দের নিজের গুরুও ছিলেন। লাহিড়ী মহাশয় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে শিশু যোগানন্দ একজন যোগী হয়ে উঠবেন এবং "আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হিসাবে তিনি অনেক লোককে ঈশ্বরের জগতে নিয়ে যাবেন"।
জীবনী
প্রাথমিক জীবন
শ্যামাচরণ বঙ্গ প্রদেশের নদীয়া জেলার ঘুর্ণী গ্রামে( বর্তমানে
কৃষ্ণনগর শহরের একটি পাড়া) একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গৌরমোহন লাহিড়ীর স্ত্রী, মুক্তকেশীর কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন। তিনি যখন শিশু ছিলেন তাঁর মা মারা যান - তাঁর মা ভগবান শিবের একজন ভক্ত ছিলেন ছাড়া তাঁর সম্পর্কে খুব সামান্য জানা যায়। মাত্র তিন/ চার বছর বয়সে, তিনি গলা অবধি বালিতে সমাহিত হয়ে, প্রায়ই ধ্যানে বসে থাকতেন। পাঁচ বছর বয়সে, পূর্বপুরুষের বাড়ি বন্যায় নষ্ট হয়ে যাওয়ায়, পরিবারটি বারাণসীতে চলে আসে, সেখানেই তিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করেন।[৩]
কাশীতে বসবাসকালীন শাস্ত্রপাঠ ও ধর্মসাধনায় বিশ্বাসী তাঁর পিতা গৌরমোহন যিনি নিজে প্রত্যহ ঋগ্বেদ পাঠ করতেন, বালক শ্যামাচরণকে বেদজ্ঞ মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ নাগভট্টের কাছে কিছুকাল বেদশিক্ষার্থীরূপে পাঠান। [১] গঙ্গায় স্নান করে বেদ পাঠ এবং পূজা তাঁর দৈনন্দিন রুটিনের অংশ ছিল। গৌরমোহন প্রাচীন ধর্ম সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হলেও শ্যামাচরণকে শিশুকাল থেকেই
উর্দু এবং হিন্দি অধ্যয়ন করান, পরে সরকারী সংস্কৃত কলেজে
বাংলা, সংস্কৃত, ফার্সি , ফরাসি এবং ইংরেজি ।[১]
১৮৪৬ সালে, তাঁর শ্রীমতি কাশীমনির সাথে বিয়ে হয়।[৪] তাঁদের দুই পুত্র ছিল, তিনকড়ি ও দুকড়ি এবং তিন কন্যা, হরিমোতি, হরিকামিনী এবং হরিমোহিনী। তাঁর দুই পুত্রকে সাধুসন্ত হিসাবে মানা হত। শালীখার পণ্ডিত বংশীয় তাঁর স্ত্রী[১] , তাঁর শিষ্য হয়ে ওঠেন এবং স্নেহভরে গুরুমা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ইংরেজ সরকারের সামরিক প্রকৌশল বিভাগের একজন হিসাবরক্ষক হিসেবে, কর্মসূত্রে তিনি সারা ভারতে ঘুরেছেন। তাঁর বাবার মৃত্যুর পর, তিনি বারাণসীতে সমগ্র পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।. [৩]
ক্রিয়াযোগ গুরু
যুক্তেশ্বর গিরি
লাহিড়ী মহাশয়ের শিষ্য
১৮৬১ সালে, শ্যামাচরণকে হিমালয়ের পাদদেশে
রানীক্ষেতে বদলি করা হয়। একদিন, পাহাড়ে চলার সময়, তিনি তাঁকে ডাকছে এমন একটি কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন। আরও উপরে চড়ার পর, তিনি তাঁর গুরু মহাবতার বাবাজির দেখা পেয়েছিলেন যিনি ক্রিয়া যোগের কৌশলগুলিতে তাঁকে পরিচয় করিয়েছিলেন। বাবাজি শ্যামাচরণকে বলেছিলেন যে তাঁর বাকি জীবনটি ক্রিয়াযোগের কথা প্রচারের জন্য উতসর্গ করতে হবে।[৩]
শীঘ্রই, লাহিড়ী মহাশয় বারাণসীতে ফিরে আসেন, যেখানে তিনি সক্রিয়ভাবে ক্রিয়াযোগের মার্গ অন্বেষণ শুরু করেন। সময়ের সাথে সাথে, তাঁর থেকে ক্রিয়া শিক্ষা গ্রহণের জন্য আরো বেশি সংখ্যক লোক আসতে লাগলো। তিনি অনেক ছোট ছোট সভা সংগঠিত করেন এবং ভগবত গীতার উপর তাঁর "গীতা সভা"তে নিয়মিত ভাষণ দেন। যে সময়ে জাতিগত বৈষম্য অনেক শক্তিশালী ছিল, হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান সহ প্রত্যেক ধর্মবিশ্বাসের জন্য তিনি উন্মুক্তভাবে ক্রিয়া দীক্ষা দেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের যা তারা ইতিমধ্যেই অনুশীলন করছিল তাতে ক্রিয়াযোগ যোগ করে, তাদের নিজস্ব ধর্মের রীতিনীতি মেনে চলার জন্য উত্সাহিত করেছিলেন।
[৩]
১৮৮৬ সালে পেনশনে অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত তিনি কর্মজীবনে হিসাবরক্ষক ও তাঁর পরিবারের দায়িত্বভারের দ্বৈত ভূমিকা এবং ক্রিয়াযোগের শিক্ষকতা অব্যাহত রাখেন। এই সময়ে তাঁকে আরও লোক দর্শন করতে আসতেন। বেশীসময় বৈঠকখানা ঘরে থাকতেন, সবার জন্য দর্শন অবারিত ছিল। তিনি মাঝে মাঝেই পরম চৈতন্য সমাধির স্পন্দনহীন অবস্থার প্রদর্শন করতেন। বছরের পর বছর ধরে তিনি মালী, পোস্টম্যান, রাজা, মহারাজা, সন্ন্যাসী, গৃহস্থ, নিম্ন বর্ণ বলে পরিচিত, খ্রিস্টান এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের দীক্ষা দেন।[৫] সেই সময়ে, একজন কঠোর ব্রাহ্মণের জন্য সকল বর্ণের মানুষের সাথে এত ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রাখা কঠিন ছিল। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে
পঞ্চানন ভট্টাচার্য, যুক্তেশ্বর গিরি, প্রবনবানন্দ, কেশবানন্দ ব্রহ্মচারী , ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল এবং পরমহংস যোগানন্দের পিতামাতা ছিলেন। অন্যান্য যারা শ্যামাচরণের থেকে ক্রিয়াযোগ দীক্ষা গ্রহণ করেন তাঁরা হলেন বেনারসের ভাস্করানন্দ সরস্বতী, দেওগড়ের বালানন্দ ব্রহ্মচারী, বেনারসের মহারাজা ইশ্বরী নারায়ণ সিংহ বাহাদুর ও তাঁর পুত্র। [৩][৬]
জীবনী লেখক এবং যোগাচারী ডঃ অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর বই "পুরাণ পুরুষ" গ্রন্থে, লাহিড়ীর ২৬ টি গোপন ডায়েরির একটি অধ্যায়ের উপর ভিত্তি করে, শ্যামাচরণ শিরডি সাই বাবাকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত করেছিলেন একথা লেখেন।[৭] তিনি তাঁর একজন শিষ্য, পঞ্চানন ভট্টাচার্যকে, ক্রিয়াযোগ শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর জন্য
কলকাতায় একটি সংস্থা চালু করার জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন। আর্য মিশন ইনস্টিটিউশন অন্যান্য আধ্যাত্মিক বই সহ গীতাতে লাহিড়ীর ব্যাখ্যা এবং গীতার বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত করেন। শ্যামাচরণ নিজে , বাংলা ও হিন্দিতে গীতা থেকে উদ্ধৃত অংশ সমেত হাজার হাজার ছোট বই মুদ্রিত করেন, এবং বিনামূল্যে বিতরণ করেন সে সময়ে এটি একটি বিরল ধারণা ছিল।[৫]
১৮৯৫ সালে তিনি তাঁর শিষ্যদের একত্রিত করতে শুরু করলেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ জানতে পারে যে তিনি শীঘ্রই শরীর ছেড়ে যাবেন। তাঁর মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে, তিনি কেবল বলেছিলেন, "আমি বাড়ি যাচ্ছি, সান্ত্বনা পাও, আমি আবার আসব।" এরপর উত্তর দিকে তিনি তাঁর শরীরকে প্রায় তিন বার ঘোরালেন এবং সচেতনভাবে তাঁর শরীর ত্যাগ করে " মহসমাধি " নিলেন। লাহিড়ী মহাশয় ১৮৯৫ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর দেহত্যাগ করেন।[৩]
শিক্ষা
ক্রিয়া যোগ
মূল আধ্যাত্মিক অনুশীলন যা তিনি তাঁর শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন সেটি অভ্যন্তরীণ প্রাণায়াম অনুশীলনের একটি ধারাবাহিক ক্রম তা হল ক্রিয়া যোগ, যা দ্রুতই অনুশীলনকারীদের আধ্যাত্মিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে । ধর্মীয় পটভূমি নির্বিশেষে শেখার জন্য আন্তরিক, এমন সবাইকে তিনি এই কৌশল শেখান। শিষ্যরা তাঁর কাছে নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে আসতেন, সবার উত্তরে, তাঁর পরামর্শ একটাই - আরো ক্রিয়াযোগ অনুশীলন। [৩] তিনি বলেছিলেন:
তিনি শিখিয়েছিলেন যে ধর্মগ্রন্থগুলির নিছক তাত্ত্বিক আলোচনা ব্যতীত ক্রিয়া অনুশীলন, যোগীকে সত্যের সরাসরি অভিজ্ঞতা দিতে পারে এবং:
গুরু-শিষ্য সম্পর্ক
শ্যামাচরণ প্রায়ই ক্রিয়া-যোগের প্রসঙ্গে গুরু-শিষ্য সম্পর্কের কথা বলেছেন। তিনি সর্বদা ক্রিয়া পদ্ধতিকে একটি দীক্ষা হিসাবে দিয়েছেন[৩] এবং শেখানো হয় যে এই কৌশলটি কেবলমাত্র গুরু-শিষ্য সম্পর্কের অংশ হিসাবে সঠিকভাবে শেখা যায়।[৩][৬] প্রায়শই তিনি সেই উপলব্ধির কথা উল্লেখ করেছেন যেটি গুরু দ্বারা শেখানোয় আসে এবং সেই করুণার কথা যা গুরুর সংস্পর্শে আসে। তিনি এটাও শিখিয়েছিলেন যে গুরুর কথা পালন করলে তাঁর করুণা স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায়। তিনি ধ্যানের সময় গুরুর সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন, পরামর্শ দেন যে তাঁকে সশরীরে দেখতে হবে সবসময়ই এটির প্রয়োজন হয় না।[৬]
তিনি ক্রিয়াযোগের জন্য গুরুর প্রয়োজনীয়তা বলতে গিয়ে বলেন:
লাহিড়ী মহাশয়ের সাথে তাঁর নিজের শিষ্যদের সম্পর্ক ছিল খুবই স্বতন্ত্র। শিষ্যদের আধ্যাত্মিক প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী আলাদা আলাদাভাবে তিনি তাঁদের ক্রিয়াযোগ শেখাতেন।---উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চব্বিশ তত্ত্ব

তন্ত্র