লালন সাঁইজির তত্ত্ব ভেদ
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
এ যাবতকাল বাংলার বাউল ফকিরদের নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তাতে দেখা যায় লালন সাঁইজীই যেন সব আলোচনার কেন্দ্রে আছেন। যত আলোচনা ও মূল্যায়ন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও লালন সাঁইজীর প্রায় একাধিপত্য। এক সাঁইজীকে নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রচুর। আমার সংগ্রহে আছে নয়টি। এর মধ্যে অধিকাংশ গ্রন্থের একটি বিশাল অংশ জুড়ে আছে সাঁইজীর জন্মস্থান ও পৈতৃক ধর্ম নিয়ে অহেতুক বিতর্ক। লালন সাঁইজী যে বিষয়ে তাঁর কোনো রচনায় সামান্যতম ইঙ্গিত পর্যন্ত দিয়ে যাননি, তা নিয়েই এত বিস্তর টানা-হেঁচড়া দেখে অবাক হতে হয়। লালন সাঁইজীর রচনা বলতে আমি তাঁর গানের কথাই বলছি। যতদূর জানা যায়, ‘পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে’ বলে তিনি যখন একতারায় টোকা দিয়ে গেয়ে উঠতেন, তখন মূলত তাঁর দুই প্রধান শিষ্য লিখে রাখতেন। তিনি অক্ষরজ্ঞানশূন্য ছিলেন কিনা সে বিতর্কে যাবো না, তবে তার নিজের হাতে লেখা কোনো পাণ্ডুলিপি যে পাওয়া যায়নি এতে কোনো সন্দেহ নেই। সাঁইজী কেবল যে গানই করতেন, শিষ্যবৃন্দকে নিয়ে তত্ত্বালোচনা করতেন না—এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু সেসব আলোচনা কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। ফলে তার গানের তত্ত্বভেদ, তার গানের বিশ্লেষণ ছাড়া অন্য কোনোভাবে করা সম্ভব নয়।
বহু পণ্ডিতজনই এই কাজটি করতে গিয়ে নানা ধরনের আভাস-ইঙ্গিতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন। সাঁইজী নিজে যেমন তাঁর জন্মস্থান কোথায়, পিতা মাতার নাম কী, সে সম্পর্কে কিছুই জানাননি তাঁর গানে; যেমন নিজের পৈতৃক ধর্ম নিয়ে—বরং বলা যায় প্রচলিত ধর্মমত নিয়ে কেবল হেঁয়ালিই করেছেন গানে গানে, তেমনই হেঁয়ালিতে ভরা তাঁর তত্ত্বের গান। এই হেঁয়ালি ভেদ করতে হলে প্রয়োজন প্রথাগত সাধারণ মাধ্যমে তত্ত্ব-সত্যের আবিষ্কার। তিনে নিজে অনুমানপন্থী ছিলেন না। তাই অনুমান দিয়ে তাকে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। তিনি এবং অন্য সব মহাজন যাকে গোপ্য বিষয় বলেছেন তা দীক্ষিতজন ছাড়া অন্যের কাছে প্রকাশ করা হয় না। তাই পণ্ডিতজনদের বিশ্লেষণে অনুমানই প্রধান হয়ে ওঠে। দীক্ষিতজনকেও গোপ্য বিষয় সম্পর্কে অবহিত করা হয় ধাপে ধাপে। সাধনার এক এক স্তর পার হওয়ার পর গুপ্তজ্ঞানের এক-একটি দরজা খুলে দেয়া হয়।
ফকিরি সাধনার মূল বিষয় মানুষ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে—মানব দেহ। পুরুষ এবং নারী মানুষের দুই বিভাজিত অংশ। ফকিরের সাধনা তাই এই দুই অংশের মিলনের সাধনা। মিলনে প্রেম উপজিত হলে সাধনা অগ্রসর হতে থাকে, কাম উপজিত হলে আবারও খণ্ড হয় এবং ‘পুত্রকন্যারূপে পুনর্জন্ম হয়’। লালন সাঁইজীর গানকে উপলব্ধির স্তরে নিতে গেলে মানুষের ভজন, প্রেম, কাম, রস, রতি, বস্তু-বিন্দু, দমের কাজ বুঝে—নিজে স্খলনরহিত হয়ে দেহ সাধন করতেই হবে। সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে সত্যে উপনীত হয়ে, সত্যের বাইরে দাঁড়িয়ে অনুমানে আভাস-ইঙ্গিত দেয়া যাবে মাত্র। সত্যে উপনীত হওয়া সহজ কাজ নয়। পরম মহাজনের দেয়া মূলধন ক্ষয় নয়, তা রক্ষা তো করতেই হবে—তারপর লাভের অঙ্ক যিনি যতগুণ করতে পারবেন তিনি সাধক হিসেবে তত উচ্চস্তরে অধিষ্ঠিত হবেন। এই সাধনপথে নিয়োজিত হয়েই বুঝেছি, এ এক দুরূহ কাজ। এই বিষয়টি নিয়ে গূঢ় আলোচনা এক দুঃসাহসের ব্যাপার। বর্তমান নিবন্ধ পূর্ণাঙ্গ আলোচনার একটি ভূমিকা মাত্র।
সেই ১৯৪৩ সালে, আজ থেকে ৭০ বছর আগে, বৃহত্তর যশোরের ঝিনাইদহ-মাগুরার সন্ধিস্থলে আমার জন্ম। আমার কৈশোর কাল পর্যন্ত প্রিয় বিচরণভূমিও ছিল ওটাই। অঞ্চলটিতে ফকিরি গান-ভাব গানের প্রচলন ছিল ব্যাপক। হরিষপুর-শৈলকূপা-হরিণাকুঞ্জ বেড়বেড়ীর মহান সাধককুলের প্রভাব বিশেষভাবে ওই অঞ্চলের ওপর থাকবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিশোর বয়সে এ জাতীয় গানের আসরের খবর পেলেই ছুটতাম। গানের ভেতরের তত্ত্বকথা বোঝার জ্ঞান তখন হয়নি (এখনও যে হয়েছে তারই বা নিশ্চয়তা কী), কিন্তু আবিষ্ট হয়ে যে শুনতাম, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি। এর দারুণ আকর্ষণ বোধ করতাম। বলা যেতে পারে দুর্নিবার। কোনো কারণে কোনো আসরে যেতে না পারলে ঘুম হতো না। তারপর এক সময় পড়াশোনার চাপে এই আকর্ষণ কমতে থাকে। কলেজ জীবনে এসে বলা যায়, পূর্ণ ছেদ পড়ে। শহর জীবনে এসে, বিশেষ করে বেতারে চাকরি গ্রহণের পর সেই বাল্য আকর্ষণের কথা বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবে যায়। ফকির-বাউলদের বৃহত্ দু’টি অঞ্চল; বৃহত্তর যশোর এবং কুষ্টিয়া তখন রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত ছিল। বলাবাহুল্য, এই দু’টি অঞ্চল ছিল ফকির বয়াতী-বাউলের জন্ম-বিকাশ ও বিচরণের বৃহত্তম স্থান। তাদের কদর এবং জনপ্রিয়তা ছিল মূলত গ্রামীণ কৃষক-শ্রমিক-মজুর ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে। তাদের মধ্যে যারা আসর জমাতে বিশেষ দক্ষ ছিলেন, মাঝে মাঝে তাদের ডাক পড়ত শহরে যেসব প্রদর্শনী হতো, কৃষি বা শিল্প প্রদর্শনী, তার যাত্রা মঞ্চে। এসব মঞ্চে মোসলেম বয়াতী, হালিম বয়াতী প্রমুখের গান শুনেছি। কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত আসরের বা গ্রামাঞ্চলের আসরে গাওয়া গানের সঙ্গে ওইসব গানের প্রভেদ অনেক। শহরের অধিকাংশ গানের অনুষ্ঠানে তাদের ভাবের চেয়ে ভঙ্গিটাই ছিল বড়। সত্যিকার ফকির-বাউল যারা—তাদের কখনোই ওইসব অনুষ্ঠানে দেখিনি।
চাকরি নিয়েছিলাম বেতারে এবং প্রথম কেন্দ্র ছিল রাজশাহী। কুষ্টিয়া এবং যশোর ছিল ওই বেতারাঞ্চলেই। পাকিস্তান রেডিওতে বাউল ফকিরি গানের কোনো নির্ধারিত বিশেষ অনুষ্ঠান ছিল না। সাধারণভাবে পল্লীগীতির অনুষ্ঠানে কেউ কেউ লালন সাঁইজীর গান গাইতেন। লালন সাঁইজীর গানের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচয় স্বাধীনতার পর। বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের লোকসঙ্গীত উত্সবের মাধ্যমে। তত্কালীন ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের পরিচালক মরহুম শহীদুল ইসলাম এবং তার সহযোগী আশরাফুল আলম ও আশরাফুল হক এই আয়োজন করেন। আজকের অধিকাংশ স্বনামখ্যাত শিল্পী সেই সময়ের আবিষ্কার। ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের বহরে পরে আমিও যুক্ত হই, যুক্ত হন বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক খোন্দকার নূরুল আলম। যাই হোক, ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের উদ্যোগেই বিশেষভাবে লালন সাঁইজীসহ বিভিন্ন মরমী সাধকের গান ধারণ করে রাখা, বিভিন্ন বেতার কেন্দ্রে প্রেরণ এবং প্রচার শুরু হয়। এসময় লালন সঙ্গীতের বিশিষ্ট গুণী সাধক মেকসেদ আলী সাঁই, খোদাবক্স বিশ্বাস, গোলাম ইয়াসিন শাহ্, বেহাল শাহ প্রমুখ আখড়াবাসীর কণ্ঠে লালন সাঁইজীর সাধন সঙ্গীত, তার প্রকৃত দ্যোতনায় শোনার সৌভাগ্য হয় ঢাকাবাসীসহ নাগরিক মানুষদের।
মোকসেদ আলী সাঁইয়ের ছাত্রী হিসেবে এলেও তখনকার তরুণী শিল্পী ফরিদা পারভীন দ্রুতই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তখনকার ফরিদা পারভীনের কণ্ঠমাধুর্য ও সহজ গায়কী মানুষকে উত্কর্ণ করতে পেরেছিল। এখনও এই শিল্পীর সেই সময়ের গানই আমার বেশি ভালো লাগে। কৃত্রিম কারুকাজের বাহুল্যবর্জিত সেই গানেই হয়তো সহজ সাধকের আত্মাটিকে অনুভব করা যায়। রবীন্দ্রনাথ সাহানা দেবীকে প্রশংসা করেছিলেন এই কারণে যে, তার কণ্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীতে সাহানা দেবী যেমন থাকত, তেমনি রবীন্দ্রনাথও থাকতেন বিশেষভাবে। রবীন্দ্রনাথের ভাব ও ভাবনাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা ছিল না সেখানে। ফরিদা পারভীনের সেই সময়ের গানে যন্ত্রসঙ্গীতের সংযোজনও কখনও মূল গানকে অতিক্রম করে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দেখাতে উদগ্রীব হয়নি। সাঁইজীর গান শুনতে বসে যদি—শিল্পীর কণ্ঠের কারুকাজের প্রদর্শনী এবং যন্ত্রসঙ্গীতের বাহাদুরিতেই মন নিবদ্ধ হয়, তাহলে আড়াল হয়ে যায় সাধকের ভাব, তত্ত্ব, আত্মবিলয়ের আর্তি, মিলনসুখের প্রশান্তি। এটা কাম্য হতে পারে না।
তখন সাঁইজীর গান শুনেছি, মুগ্ধ হয়েছি। মুখোমুখি ঘরোয়াভাবে মোকসেদ আলী সাঁই, খোদাবক্স বিশ্বাস, গোলাম ইয়াসিন শাহ্, বেহাল শাহ্সহ আরও বেশ ক’জন সাধক শিল্পীর গান বহু-বহুবার শোনার ভাগ্য হয়েছে। কিন্তু তখন মুগ্ধতার বাইরে কোনো অনুসন্ধিত্সা জাগেনি মনে। ১৯৯৯ সালে এক অবিশ্বাস্য আত্মচৈতন্য সংঘাত আমার বোধে যে বিপুল আলোড়ন তোলে, তা আমাকে আধুনিক গানের কবিতা রচনার পাশাপাশি, অথবা তাকে ছাপিয়ে এক ভিন্ন আলোয় মন ধাঁধিয়ে দিয়ে অনুসন্ধিত্সু করে তোলে। নিজের মনোজ সেসব গানের অর্থ খুঁজতে গিয়ে কেন যেন মনে হয় সাধক মহাজনদের মহারত্নের আয়নার প্রয়োজন। ২০০৩ সালে আমার এই ধরনের গানের প্রথম সঙ্কলন ‘ঘোর’ প্রকাশের পর বিভিন্ন গানের কবিতা নিয়ে যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন হই এবং স্বয়ংসিদ্ধভাবে যে উত্তর দিই, তা যাচাইয়ের কষ্টিপাথর খোঁজার তাগিদেই খুঁজতে থাকি মহাজন সাধক কবিদের গান। ২০০৫-এর মধ্যে মুদ্রিত আকারে পাওয়া যায় এমন সব গ্রন্থ সংগ্রহ করে ফেলি। এর মধ্যে বিশেষ করে লালন সাঁইজীর গান, তার বিষয়-ভাব-তত্তব প্রকাশের অলৌকিক কৃতিত্ব, সুফিবাদ, বৈষ্ণববাদ, কোরআন ও বেদের জ্ঞান, অন্তর্জাগতিকতা থেকে আন্তর্জাতিকতা, দেহ থেকে দেহাতীতে বিচরণের সহজতা নিয়ে, আমার কাছে অপার বিস্ময়ের জগত মেলে ধরে।
অতিদ্রুত সাঁইজীর গান নিয়ে যত আলোচনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাও পড়তে শুরু করি। সেই সব পণ্ডিতজনের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, সাধক জনের কণ্ঠে সাঁইজীর গান শুনে এবং মুদ্রিত বই পড়ে যে মহাভাবের সন্ধান পাই— তা পণ্ডিতজনদের বিশ্লেষণে পাই না। কোথায় যেন সমাজ সংস্কার বা তত্ত্বের কঠিন কচকচিতে সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়। অনেকটা জানালা দিয়ে দেখা আকাশের মতো। সাঁইজীর গানে ব্যবহৃত বিশিষ্ট অর্থবাচক বিভিন্ন শব্দের অর্থ নির্ণয়ের চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু একই শব্দ বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন দ্যোতনা সৃষ্টি করে বা ভিন্নার্থক হয়ে ওঠে সাধক কবির গানে। বিশেষ করে লালন সাঁইজীর গানে এমন ধরনের শব্দ আছে প্রচুর। কোন গানে কী অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা বিশ্লেষণসহ না বোঝালে কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। যেমন চারিচন্দ্র। যখন চারিচন্দ্র ভেদ বলা হয়েছে, তখনও ভিন্ন স্থানে ভিন্ন অর্থজ্ঞাপক হয়েছে। সাধন পদ্ধতি সম্পর্কে যখন বলা হয়েছে তখনও এর অর্থ দু’টি। আবার চাঁদে চাঁদে মিলনের কথা যখন বলা হয়েছে, যেমন ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’, তখন এর অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘চাঁদে চাঁদে চন্দ্রগ্রহণ’ বলতে আগের কোনো অর্থই আর থাকেনি। আবার ‘অমাবস্যায় পূর্ণিমা হয় অর্থাত্ পূর্ণ চাঁদের উদয় হয়—এই চাঁদও আগের কোনো অর্থকে বহন করে না। চাঁদের সংখ্যাও আবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন। অর্ধটি, একটি, দু’টি, তিনটি, চারটি, অষ্টচন্দ্র, চব্বিশ চন্দ্র ইত্যাদি। চন্দ্রকলার ক্ষেত্রে চৌষট্টি কলার উল্লেখ আছে। এছাড়াও মুর্শিদ, নারী, পুরুষ, শুক্র এবং অণ্ডকেও চন্দ্র বলা হয়েছে কিছু কিছু গানে। সাধন তত্ত্বভিত্তিক এক-একটি গানের মূল ভাবের সঙ্গে মিলিয়ে অর্থ না করলে এসব শব্দের ব্যবহার বোঝা সম্ভব নয়।
বহু ক্ষেত্রে, সাধক বা খিলাফতপ্রাপ্ত কারও কাছে ছাড়া এই অর্থ জানাতে নিষেধ আছে। কারণ, এসব গান সাধক ফকির তার সাধনার বিভিন্ন স্তর অতিক্রমের অনুভব থেকে, আবেগ থেকে, উপলব্ধি থেকে গেয়ে উঠেছেন। সাধন পথের পথিক ছাড়া অন্য যে কেউ খণ্ডার্থের ধাঁধায় ভুল বুঝতে পারেন। বিশেষত সৃষ্টিরহস্যের বিষয় নিয়ে রচিত গান অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ পর্যায়ের সাধকও বুঝতে পারেন না। সুফি সাধনায় যেমন সৃষ্টিরহস্যের জ্ঞান মুর্শিদ নির্দেশিত পথে চলে, অর্জন করতে হয়—না হলে তা স্থায়ী বিশ্বাসে পরিণত হয় না, ফকিরি সাধনাতেও তাই। পর্যায়ের পর পর্যায় পার হয়ে না এলে এ জ্ঞান ধারণ করা যায় না। অত্যন্ত ভাসা-ভাসা জ্ঞান নিয়ে বা বাউল ফকিরি গানের শিল্পী হওয়ার অধিকার নিয়ে, বিশেষ করে লালন সাঁইজীর গানের অর্থ করতে যাওয়া ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কারণ, তাতে অন্যের মনে ভুল ধারণা দেয়ার পাপ করা হয়। এই ধরনের ভণ্ডামি থেকে সাধন সত্যের গানকে মুক্ত করা যাবে কিনা জানি না। তবে করা প্রয়োজন। করতে হলে, সাঁইজীর প্রতিটি গান নিয়ে তাকে মর্মে উপলব্ধি করে, তার ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। এ নিয়ে দ্বিমত হতে পারে, বহুমতও হতে পারে। হোক। সাধন জ্ঞান থেকে যে ব্যাখ্যা হবে, অবশেষে স্থায়ী হবে সেটাই।
কত প্রশ্নই তো চিন্তার জগতে অহরহ আসে, যেমন—জীবন সত্য, না জীবনের মূল্য সত্য? সত্য দুটোই। একটি ক্ষণস্থায়ী, অন্যটি চিরস্থায়ী। প্রশ্ন আসে, দেহ সত্য, না দেহ যে কারণে চলমান সেই কারণ সত্য? এখানেও উত্তর সেই একই। দুটোই সত্য। একটি নশ্বর, অন্যটি অবিনশ্বর। কিন্তু যা চিরস্থায়ী অথবা অবিনশ্বর, তাকে পাব কোথায়? কারণ সেটা তো গোপন, দৃশ্যমান নয়। দৃশ্যমান না হলেও তার অস্তিত্ব আছে। যা না থাকলে এই দেহটির নাম হয়ে যায় ‘লাশ’, তা এই দেহের মধ্যেই তো আছে। আছে গোপনে। সেই গোপনকে জানাটাই সাধনা। দেহকে বাদ দিয়ে সেই সাধনা হয় না, দেহসর্বস্ব হয়েও সেই সাধনা হয় না। ভুল ব্যাখ্যায় এই দু’টি ভুল পথে যাওয়ার আশঙ্কা অন্তরায়ই যায়।---সংগৃহীত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন